শুক্রবার ১৫ জুলাই ২০১১ ৩১ আষাঢ়১৪১৮ ১২ সাবান ১৪৩২ বছর ০৬ সংখ্যা ৩৯৩
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন-ভাতা
মো. রহমত উল্লাহ্
[ দীর্ঘদিন পর শিক্ষাক্ষেত্রে যতটুকু অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন
বর্তমান
শিক্ষামন্ত্রী, তাতে
অনেক বেড়েছে শিক্ষকদের আশা ও বিশ্বাস। তিনি বারবার
বলছেন, নতুন
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের
সহায়ক ভূমিকা। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, শিক্ষকদের প্রতি তিনি অত্যন্ত
শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক। আশা করি আমরা শিগগিরই
বাস্তবে দেখতে পাব তার এ
আন্তরিকতার প্রমাণ। দূর হবে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের কষ্ট। ]
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মে-২০১১ মাসের সরকারি বেতন-ভাতা পেয়েছেন দুই মাস পর অর্থাৎ জুলাই-২০১১ মাসে। জানা যায়, শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা, গত ১৯ জুন ২০১১ তারিখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বরাবর এ বেতন-ভাতা প্রদানের আদেশ প্রদান করেন। যার স্মারক নং- 'ওএম-১৯/ বিশেষ/ ২০১১/ ৮৭১২/ ৪ বিশেষ তারিখ ২৯.০৬.২০১১ ইং'। এতে ২৬ জুন ২০১১ তারিখের মধ্যে শিক্ষকগণের প্রাপ্য মে মাসের বেতন-ভাতা প্রদানের কথা বলা হয়। পত্রিকান্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান / শিক্ষকদেরও জানানো হয় ২৬ জুনের মধ্যে তাদের বেতন-ভাতা উত্তোলন করার জন্য। সঙ্গত কারণেই প্রতিদিন ব্যাংকের শাখা অফিসে ছুটেছেন অভাবী শিক্ষকরা। নির্ধারিত সময়ের ৩-৪ দিন পরে পাওয়া যায় সোনার হরিণ সেই পত্রটি। যা দিয়ে আর মে মাসের বেতন উঠানো যায়নি জুন মাসেও! এতদসংশ্লিষ্ট অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার স্মারক নং - 'প্রশা/ ব্যাংকিং/ শিক্ষা/ ৪৮০/ ১১ তারিখ: ২৬.০৬.২০১১ ইং' যুক্ত একটি পত্রে দেখা যায় প্রধান কার্যালয় এ বেতন প্রদানের জন্য তাদের শাখা অফিসকে আদেশ দিয়েছেন শেষ তারিখে অর্থাৎ ২৬ জুন তারিখে। শাখা অফিসে বারবার ধর্না দিয়ে সেই পত্রের ফটোকপি শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো আনতে পেরেছে ২৯ জুন তারিখে। এ পুরনো প্রক্রিয়াটি নানান রকম প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত, সরকার নিজেই কেন শিক্ষকদের বেতন প্রদানের আদেশ দিয়েছে অনেক দেরিতে?
যেখানে সরকারি সব কর্মকর্তারা (যারা এ আদেশ দিয়েছেন তারাও) মে মাসের বেতন পেয়েছেন জুন মাসের ১-২ তারিখের মধ্যে, সেখানে কেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন-ভাতা প্রদানের আদেশ দিয়েছেন ১৯ জুন তারিখে?
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা অধিদপ্তরের লিখিত আদেশ পাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় কেন এ আদেশটি তাদের শাখা অফিসের বরাবরে অগ্রায়ণ করেছেন ৭ দিন পর অর্থাৎ ২৬ তারিখে?
তৃতীয়ত, একই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে একই শহরের শাখা কর্যালয়ে অগ্রায়ণকৃত আদেশপত্রটি আসতে এ ডিজিটাল যুগে কেন ৪ দিন অর্থাৎ ২৯ তারিখ পর্যন্ত সময় ব্যয় হলো? অথবা সঠিক সময়ে আদেশটি পেয়ে থাকলে শাখা অফিস কেন ৪ দিন গোপন করে শিক্ষকদের অতিরিক্ত আরো ৫-৭ দিন উপোষ রাখল? ব্যাংকাররা কি মে মাসের বেতন তুলে নেননি মে মাসের ৩১ তারিখে বা জুন মাসের ১-২ তারিখে?
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে,
কোনো নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে কেন দেয়া হয়নি শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আদেশপত্র দুটি? কেন প্রতি মাসে সময় ও ভাড়া ব্যয় করে ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ২০-৩০ টাকা দিয়ে আনতে হয় একটি চিঠির ফটোকপি? প্রতি মাসে বেতন-ভাতা উঠানোর জন্য কেন বারবার ব্যাংকে জমা দিতে হবে একই ডিড ও কাগজপত্র এর ৫০-৬০ কপি? ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার দুই বৎসর পরও কেন ওয়েবসাইটে নিয়মিত দেয়া হচ্ছে না এ সব অতি জরুরি ও জন-গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চিঠি-পত্রাদি?
এখনো কেন দূর করা হচ্ছে না দীর্ঘ দিনের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি?
অথচ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার আদেশসহ সব পত্রাদি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে দেয়া হলে সহজে, স্বল্প ব্যয়ে ও সঠিক সময়ে তা পেতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারীরা। এমনিতেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি মাসের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেয়া হয় পরের মাসের ১০-২০ তারিখে। পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী তথা প্রাতিষ্ঠানিক সচ্ছলতার অভাবে প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষকরাই পাচ্ছেন না প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা। বিশেষ ২-৪টি বিষয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষক হয়তো করতে পারছেন টিউশনি। বাকি সবাই কেবলমাত্র সরকার থেকে প্রাপ্ত মূল বেতন +১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া + ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা মাত্র পেয়ে থাকেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে এতেই চালাতে হয় সংসারের সব খরচ। দিতে হয় সন্তানের স্কুল/কলেজের বেতন, খাতা-কলম, কাপড়-পোশাক, চিকিৎসা খরচসহ নানানমুখী নিয়মিত ও অনিয়মিত ব্যয়ের অর্থ। মাসের টাকায় মাস চলাই কঠিন। তার ওপরে দুমাস চলবেন কীভাবে?
এ যে এখন দেশীয় ফলের ভরা মৌসুম। সবাই ফল কিনছে,
খাচ্ছে। ফল কি খেতে ইচ্ছে করে না বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের? লাল লাল লিচু তো এবার আর পাওয়া যাবে না। তালের শাঁস তো এখন আর কচি নেই। আমলকি,
জামরুল, কালোজাম সবই তো এখন শেষ। কী দিয়ে ফল কিনবেন বেসরকারি শিক্ষকরা?
যেখানে বাড়ি ভাড়ার জন্য তাগাদা করছে বাড়িওয়ালা। চাল, ডাল, লবণ, তেল আর বাকি দিতে চাচ্ছে না মহল্লার মুদি দোকানি। অসুস্থ মা/বাবা/স্ত্রী/পুত্র/কন্যাকে দেখানো যাচ্ছে না ডাক্তার,
দেয়া যাচ্ছে না জরুরি ওষুধ। কী বলে সান্ত্বনা দিবে তাদের?
এটি যে শুধু এবারকার ঘটনা তা নয়; প্রায় প্রতি বৎসরই মে মাসের বেতন-ভাতা জুলাই মাসে এবং নভেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পরের বছরের জানুয়ারি মাসে নিতে হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের। ঈদের/পূজার আগে নিয়মিত দেয়া হয় না তাদের প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও বোনাস। শেষ পর্যন্ত কমমূল্যে বেতনের চেক বিক্রি করে কোনোভাবে পার করতে হয় পূজা/ঈদ, এমন খবর অনেক দিনের। তখন কী যে কষ্টের হয় সেই পূজা /ঈদের আনন্দ তা কি বুঝতে পারেন আমাদের সরকার ও সমাজপতিরা?
যুগ যুগ ধরে এমনিভাবে অবহেলিত আমাদের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা! অনেকেই বলে থাকেন সরকার ও সরকারি ব্যাংক ইচ্ছে করেই পরিকল্পিতভাবে প্রতি বছর মে মাসের বেতন জুলাই মাসে এবং নভেম্বর মাসের বেতন পরের বছরের জানুয়ারি মাসে দিয়ে থাকেন। এতে করে অর্থবছর ও পুঞ্জিকা-বছরের শেষ দিনে অর্থাৎ জুন মাসের ৩০ তারিখে এবং ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমার পরিমাণ বেশি থাকে। আর এ জমার পরিমাণ বেশি থাকার কৃতিত্ব দেখিয়ে সরকারি ব্যাংকাররা টার্গেট বোনাস পেয়ে থাকেন। অবস্থাদৃষ্টে মনেও হয় এমটি। এটি যদি সত্যি হয়, তো কেমন নিষ্ঠুর এই ব্যক্তিরা?
তাদের যারা পড়িয়েছেন,
তাদের সন্তানদের যারা পড়াচ্ছেন সেই শিক্ষকদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক আটকে রেখে, উপোষ রেখে, কষ্টে রেখে কীভাবে পারেন তারা ভালো থাকতে?
তাদের বোনাস পাওয়ার প্রয়োজনে যদি বছরের কোনো ২-১ দিন ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতেই হয়, তো ব্যাংকারগণ নিজেরা ২-৪ মাস বেতন উত্তোলন না করলেই পারেন। তারা তো সংখ্যায় কম নয়। তাদের বেতনের পরিমাণও তো বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া বেসরকারিদের মতো সরকারিদের বেতন-ভাতাও ব্যাংকে জমা থাকতে পারে ২-১ মাস। তাতে ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ এবং বোনাসের পরিমাণ আরো বেশি হবে না কি? এটি যদি সত্য না হয়, তো কেন বেসরকারি শিক্ষকরা সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা না পেয়ে অনটনে কষ্ট পাচ্ছেন বারবার, তা কি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নেই সরকারের?
যাদের কারণে বিলম্বে বেতন প্রদানের দায়ে বারবার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে সরকারের, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্রমাণ করা উচিত নয়কি সরকারের সদিচ্ছা? এ বিপুল সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন-ভাতা সঠিকভাবে বণ্টনে যদি সরকারি ২-৩টি ব্যাংক এমনিভাবে বারবার ব্যর্থতা বা অবহেলা দেখায়, তো তাদের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বণ্টন করতে অসুবিধা কোথায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবিধা/চাহিদা অনুসারে ব্যাংক ও ব্যাংকের শাখা নির্ধারণ করে শিক্ষকদের কিছুটা মুক্ত করা যায় না সরকারি ব্যাংকারদের অবহেলা ও হয়রানি থেকে ? বর্তমান সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী একাধিক বার বলেছেন,
শিক্ষকদের জন্য সতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করা হবে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেল তো শুরু থেকেই একরকম স্বতন্ত্র। তাদের এক সময় সরকার থেকে দেয়া হতো না কিছুই। পরে দেয়া শুরু হলো ৫০%, ৬০%, ৭০%, ৮০%, ৯০% অনুদান/বেতন। বর্তমানে দেয়া হচ্ছে ১০০% বেতন, ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা আর ২৫%/৫০% বোনাস,
সারাজীবনে একটা ইনক্রিমেন্ট! এক মাসের টাকা দেয়া হচ্ছে পরের মাসের মাঝামাঝি সময়ে বা তারও পরের মাসে। এ বেতন-ভাতা কি স্বতন্ত্র নয়? প্রথমে তো প্রয়োজন এ বৈষম্য নিরসন করা। নিশ্চিত করা প্রয়োজন তাদের প্রাপ্য বোনাস ও ভাতাদি। তারও আগে নিশ্চিত করতে হবে প্রতি মাসের ১-২ তারিখে বেতন-ভাতা প্রদান। যা দিতে হবে, তা সময় মতো দিয়েই নিতে হবে ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাক্ষেত্রে যতটুকু অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী, তাতে অনেক বেড়েছে শিক্ষকদের আশা ও বিশ্বাস। তিনি বারবার বলছেন, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের সহায়ক ভূমিকা। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, শিক্ষকদের প্রতি তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক। আশা করি আমরা শিগগিরই বাস্তবে দেখতে পাব তার এ আন্তরিকতার প্রমাণ। দূর হবে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের কষ্ট।
মো. রহমত উল্লাহ্: শিক্ষাবিদ, লেখক, গীতিকার এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা , md.rahamotullah21@ymail.com
মো. রহমত উল্লাহ্: শিক্ষাবিদ, লেখক, গীতিকার এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা , md.rahamotullah21@ymail.com
016 73 62 02 62
( লেখাটি পড়েছেন ১০০৫ জন )
No comments:
Post a Comment