Tuesday, July 30, 2013

শিক্ষা যেন এখন আরো উচ্চ মূল্যের পণ্য

 ঢাকা, সোম, ৩০ জানুয়ারী ২০১২, ১৭ মাঘ ১৪১৮
 মো. রহমত উল্লাহ  
আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যত বেশি, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তত কম। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের যেখানে বসবাস, সেই গ্রামাঞ্চলে এমনকি উপ-শহরেও ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। তুলনামূলকভাবে গ্রামের মানুষের অধিক অনটন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ধারাবাহিক অভাবই এর প্রধান কারণ।
সুযোগেই শহর কেন্দ্রিকভাবে গজিয়ে উঠেছে হাজারো শিক্ষা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এরই মধ্যে দুএকটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে হয়নি তা নয়। কিন্তু অতীতের নীতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে তারাও সর্বাংশে দিতে পারেনি-পারছে না সঠিক শিক্ষা। শ্রেণীকক্ষে প্রকৃত শিক্ষা যা- হোক তাদের ব্যাপক প্রচারে বা শিক্ষার্থীর অভিভাবকের প্রচেষ্টায় ভালো রেজাল্ট করে এমন কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া মাত্রই অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুনতে হয় ডোনেশন, ভর্তি ফি, সেশন ফি, টিউশন ফি, ড্রেস ফি, আই.ডি. ফি, বেজ ফি, টিফিন ফি, ট্রান্সপোর্ট ফি, উন্নয়ন ফি, সার্ভিস চার্জ এবং আদার চার্জ  ইত্যাদি নামে মোটা অংকের অতিরিক্ত টাকা। সেই সাথে স্কুলে জমা দিতে হয় টিস্যু পেপার, রং পেন্সিল, আর্ট পোপার, চার্ট পেপার, পোস্টার পেপার, কাটার, সিসার, বোর্ড মার্কার, পারমানেন্ট মার্কার ইত্যাদি সামগ্রী। আর শিক্ষার্থীকে তো দিতে হবেই বই, খাতা, কলম এবং প্রাইভেট টিউটর
এক্ষেত্রে কোন কোন প্রতিষ্ঠান আবার আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বার মাসের কিস্তি করে আদায় করে থাকে ডোনেশন/ উন্নয়ন ফি। কিন্তু মাফ নেই! অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এসকল ফি-এর পরিমাণ এত বেশি হয় যে, প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার নির্ধারিত বেতন-ভাতায় খেয়ে-পরে একটি সন্তানকে যোগ্যতানুসারে কাঙ্ক্ষিত স্কুলে ভর্তি করানোই অসম্ভব। পড়ার খরচ চালানো তো পরের কথা। প্রাইভেট বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত বোর্ড/ করপোরেশন/ প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিশেষায়িত ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়ার যোগ্যতা আমাদের অনেক সন্তানের থাকলেও পড়ানোর সাধ্য সাধারণ অভিভাবকের নেই। কোন রকম দায়সারাভাবে ইংলিশ ভার্সন চালু করতে পারলে তো আর কথাই নেই। সে সকল প্রতিষ্ঠানের ধারে-কাছে যাওয়াও মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব নয়।দুটি সন্তানই যথেষ্টহলেও দুটি সন্তানের পড়ার খরচ দিয়ে সংসার চালানোর জন্য মাসে যত টাকা আয় করলে যথেষ্ট, তত টাকা কিভাবে আয় করবে একজন সরকারি চাকুরে বা সাধারণ বৈধ আয়ের মানুষ? এহেন পরিস্থিতিতে অর্থাভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আজো বঞ্চিত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে। আবার কেউ কেউ সস্তায়/ লিল্লায় নিয়ে নিচ্ছে কর্মবিমুখ শিক্ষা! বিভিন্নমুখী বিশৃঙ্খল শিক্ষা অশিক্ষার কারণেই আজ এক জাতিতে শত দল। টাকার জোরে তুলনামূলক কম মেধাবীরা কিনে নিচ্ছে শিক্ষা সনদ, দখলে নিচ্ছে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ! বৈধ/অবৈধ উপায়ে হাজার গুণ উসল করে নিচ্ছে শিক্ষা খাতে ব্যয়কৃত বিপুল অর্থ। অপরদিকে অতিরিক্ত টাকার জোগান দিতে ব্যর্থ অধিক মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে যথাযথ শিক্ষা পদ লাভের অধিকার থেকে। ফলে অধিক মেধাবীদের সেবা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্র রাষ্ট্রের নাগরিক। কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না আমাদের জাতীয় অগ্রগতির চাকা
শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার থেকে যুগ যুগ বঞ্চিত হয়েছেন আমাদের পূর্বসূরীরা। সুশিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য অনেক আন্দেলন-সংগ্রাম করেছি আমরা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দেলনে পাকিস্তানী পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে আমাদের। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উপস্থাপিত ১৯৬৬-এর দফা এবং ১৯৬৯-এর ১১ দফাতেও বিশেষভাবে যুক্ত ছিল শিক্ষার অধিকার আদায়ের দাবি। কাগজ-কলমসহ শিক্ষা উপকরণের উচ্চমূল্যের প্রতিবাদে আমরা ফুঁসে উঠেছি বার বার। সুনিশ্চিত করতে চেয়েছি সবার অন্ন-বস্ত্রসহ সুশিক্ষার অধিকার। অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করেছি দেশ। প্রত্যাশা ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের সকল নাগরিক অধিকার। সুশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না আমাদের সন্তান। অথচ শিক্ষা যেন এখন আরো অনেক উচ্চ মূল্যের পণ্য। এখানে চরমভাবে বিদ্যমান ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য।
সঠিক সরকারি পদক্ষেপ ব্যতীত নিশ্চিত করা সম্ভব নয় সবার জন্য শিক্ষা। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার পাশাপাশি নিতে হবে কিছু স্বল্পমেয়াদী জরুরি পদক্ষেপ। এখনই শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে অবাঞ্ছিত শিক্ষা ব্যয়ের লাগাম। নির্ধারণ কার্যকর করে দিতে হবে বিভিন্ন ফি-এর সর্বোচ্চ পরিমাণ। কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে ডোনেশনসহ বিভিন্ন অযৌক্তিক অর্থ আদায়। অমান্য করলে বাতিল করে দিতে হবে গভর্নিং বডি, বন্ধ করে দিতে হবে এমপিও  এবং পাঠদানের অনুমতি। সেইসাথে সারা দেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মনে রাখতে হবে, হাজারো অনিয়মের মাধ্যমে গজিয়ে উঠা যেনতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে তা সম্ভব হবে না কোন দিনই। বরং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় চেতনা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার উপযোগী নাগরিক-কর্মী তৈরির প্রয়োজনে প্রত্যক্ষ সরকারি সহায়তায় বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে জাতীয় শিক্ষাক্রমের আওতায় উন্নত মানের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ শহরে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য সুনিশ্চিত করতে হবে জাতীয় চেতনা সমৃদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক উত্পাদনক্ষম কর্মমুখী নৈতিক শিক্ষা
l লেখক :অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা
E.mail- md.rahamotullah52@gmail.com

No comments:

Post a Comment