Tuesday, July 30, 2013

ব্যর্থ রাজনীতির উপহার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।



দৈনিক মানবচিন্তা

মুক্তচিন্তা

ব্যর্থ রাজনীতির উপহার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

শনিবার, 04 মে 2013 20:10 | প্রকাশের তারিখ | হিটস: 17

মো. রহমত উল্লাহ্
অনেকেই বলে থাকেন, বর্তমান মহাজোট সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করতো তাহলে বিরোধী জোটের আন্দোলন এত সহিংস রূপ নিতো না বা নিতে পারতো না। যারা এই বক্তব্য দিচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন যেআজকে বি.এন.পি. নেতৃত্তাধীন জোট যদি আওয়ামিলীগ নেতৃত্তাধীন জোটের মতো নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় থাকতো তাহলে তারাও
কি একই ভাবে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল করতো না এবং আওয়ামীলীগ নেতৃত্তাধীন মহাজোট  যদি বিরোধী দলে থাকতো তাহলে তারাও কি এই দাবিতেই আন্দোলন-সংগ্রাম করতো না? কেউ স্বীকার করুক আর না- করুক, আসলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার এবং যাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক দল/জোট যেনো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এজন্যই আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটিতে জন্ম নিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাজনীতিকদের উপর রাজনীতিকদের আস্থার অভাবই এর প্রধান কারণ। তদুপরি শ্রদ্ধাতো দূরের কথা; স্বীকারই করতে চায় না একে অপরের অস্থিত্ব। সরকারি জোট বলছে- দেশের মানুষ এখন আর চায় না সেই ভয়াবহ অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তাদের ভাষায় মনে হয় যেনো বিরোধী জোটের ৩৫% শতাংশেরও অধিক ভোটার এদেশের মানষ নয়! আবার বিরোধী জোট বলছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের সকল মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তাদের কথায় মনে হয় যেনো সরকারি মহাজোটের ৪০% শতাংশেরও বেশি ভোটার এদেশের মানষ নয়! নেতাদের এই হারজিত খেলায় জনসাধারণ বা কর্মী-সমর্থ দাবার গুটি ছাড়া আর কী?  

আজ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবদায়ক সরকার পুনপ্রর্বতনের দাবিতে বিরোধী জোটের চলমান আন্দোল যতটা জোরদার হবার সম্ভাবনা ছিলো ততটা হচ্ছে না। এর নানাবিদ কারণের মধ্যে সরকারি দমন-পীড়ণ বিরোধী জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তাদের রাজনৈতি অবস্থান উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে যোদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তাদের অন্তরে বাহিরে দ্বৈত অবস্থান নিজেদের প্রগতিশীল নেতা-কর্মী-সমর্থ এবং জনসাধারণের কাছে পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কারণে তারা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই শুভশক্তি হীন বলে মনে করেন অনেকেই। সাম্প্রতিক হরতাল জনিত নাশকতাও বিরোধী জোটে অপশক্তি বা বহিশক্তির সত্রিয়তারই  প্রমান। এই অপশক্তি/বহিশক্তির অপকর্মের দায়ভার নেতাদের ঘাড়ে চাপার কারণে  নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবদায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রবর্তনের দাবিতে শুভ শক্তির সমন্বয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার করার সুযোগ পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে। তদুপরি গণজাগরণ আন্দোলন এবং হেফাজত আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠন ব্যক্তিবর্গের বিরোধীতা বা সমর্থন- অংশগ্রহণের ফলে এদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের বিশেষ করে গণ্যমান্যদের আসল চেহারা এখন সবার কাছেই পরিস্কার। কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুক বা না- থাকুক তাদের অবস্থান এখন আর অস্পষ্ট নেই। এমন কি, যে ইমাম সাহেবের পিছনে নামাজ আদায় করছেন মুসলমানগণ সেই ইমাম সাহেব কোন্ মার্কয় ভোট দিতেন বা দিবেন তা জানাছিলো না এতোদিন। এখন তা- পরিস্কার সবার কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশী বিদেশী কোন চাপের কারণে বা সদিচ্ছা জাগ্রত হবার ফলে যদি বর্তমান ক্ষমতাশীন মহাজোট সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবদায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রবর্তন করে, তাহলে কী বর্তমান রাজনৈতি অস্থিরতা কেটে যাবে না কি আরো বেড়ে যাবে? প্রথমতনির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবদায়ক সরকার গঠন করার জন্য সকল দলের বিশেষ করে পুরাতন দুই জোট এবং সাম্প্রতিক আর্বিভূত দুই শক্তির সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ মানুষ বাছাই বা নির্বাচন করা। বর্তমানে এদেশে এমন দুএকজন বিচারপতি, ব্যারিস্টার, এডভোকেট, সম্পাদক, সাংবাদিকভিসি, অধ্যক্ষ, হেডস্যার, শিক্ষক, শিল্পপতি, শিল্পী-সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, এনজিও প্রধান, সচিব, আমলা, ইমাম, হুজুর, মোয়াজ্জিন খোঁজে পাওয়া যাবে না যাদেরকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবদায়ক সরকারের প্রধান বা সদস্য হিসেবে সবাই সাদরে মেনে নিবে। বিরোধী দলীয় নেতার কথামতে বলতে হয় পাগল আর শিশু ব্যতীত কেউ নিরপেক্ষ নেই। আসলে সত্য পক্ষইতো নিরপেক্ষ। এমন মানুষতো থাকতে হবে এবং আছে যিনি সত্য পক্ষ অবলম্বন করবেন তাঁর প্রতিটি কথায় কাজে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির ময়দানে তাঁরা আসবেন না এবং তাঁদেরকে আনাও হবে না। এই রাজনীতির ময়দানে নিরপেক্ষ হিসেবে হয়ত স্থান পাবে এমন জন, যাদের দৃষ্টিতে সত্য-মিথ্যার মিশ্রনই সত্য বা সঠিক। যেমন: একজন বললেন- ‘তিনে দুয়ে পাঁচ আরেকজন বললেন- ‘না, তিন দুগুণে ছয় অন্য একজন (তথাকথিত নিরপেক্ষ) এসে বললেন- ‘তোমাদের কারোরটাই সঠিক নয়; তিনে দুয়ে মিলে সাড়ে পাঁচই হয় এমন বর্ণচোরা নিরপেক্ষ কিংবা পাগল/শিশু দিয়েতো আর সরকার গঠন করা চলবে না। যারা দুপক্ষকেই খুশি রাখার অসৎউদ্দেশে বলে থাকেন- ‘তিনে দুয়ে মিলে সাড়ে পাঁচই হয়সেইসব নিরপেক্ষরা(?) আসলে কি সত্য পক্ষদ্বিতীয়ত: আদালতের অল্টারনেটিভ অপশন অনুসারে আসন্ন দুই টার্মের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনপ্রবর্তন করা হয় এবং এখনকার মতো নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যদি পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা কি একইভাবে এই ব্যবস্থা বাতিল করতে পরবে না? একই ভাবে কি তখনকার বিরোধীদল আন্দোলন করতে পারবে না? কিংবা আদালতের প্রস্তাবিত দুই টার্ম যখন শেষ হবে, তখনও তো কোন না কোন দলীয় সরকারই ক্ষতায় থাকবে এবং কোন না কোন রাজনৈতিক দল/জোট বিরোধী দলে থাকবে। তখনকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নিবে কি তখনকার বিরোধী দল? তখন কি আবার চলবে না এমন জ্বালাও পোড়াও? তৃতীয়ত: পরস্পরের প্রতি অনাস্থার কারণে অরাজনৈতি ব্যক্তিদের হাতে বার বার ক্ষমতা প্রদানের ফলে আরো বেশি রোদ্ধ হয়ে পড়বে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর মানুষের আস্থা ফিরে আসার পথ। রাজনীতিকগণ আস্থাহীনতার চরমে পৌঁছে গেলে অনিবার্যভাবে কি ক্ষমতাশীন হয়ে যাবে না অন্যকোন শক্তি?

রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটিতে জন্ম নেওয়া এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসেন সেই তারাতো এই তারাই; যারা এখন সরকার দলে বা বিরোধী দলে। তারা সবাই যদি এতই আস্থাহীন হয় তো যতই নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক তাদের কারোর হাতেইতো মনে হয় নিরাপদ নয় আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা! বার বার অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধাযক সরকারের লোকজন নিরপেক্ষতার পরিক্ষায় পাশ করে পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দিতে হবে কেনো; (রাজনীতিকদের ভাষায়) অনিরপেক্ষ অনির্ভরশীল রাজনীতিকদেরই হাতে? যারা রাজনীতি করে তাদেরকেই তো দিতে হবে নিরপেক্ষতার পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্ত্বীর্ণ হয়ে জনগনের আস্থা অর্জন করে হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার অথবা অনাস্থা কুড়িয়ে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ। এখত তো আর  ‘না হাঁ, হাঁ হাঁ, সব হাঁ’   অথবাহুন্ডা গুন্ডা ডান্ডা, নির্বাচন থান্ডাসেই দিন নেই। এখনতো মোবাইল ফোনের ভিডিও এবং প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ক্যামেরার বদৌলতে সাথে সাথেই সবাই দেখতে পারে অজপাড়া গাঁয়ে সংগঠিত নারী/পুরুষ নির্যাতন বা জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। আগের মতো ভোট চুরি/ডাকাতি করে গোপন রাখা এখন কি আর সম্ভব? একান্ত গোপনীয় স্কাইপে সংলাপ, ফেইজবুক/ব্লগের লেখাইতো গোপন থাকছে না এখন। কে কখন কোথায় কীভাবে গাড়িতে পেট্রোল  ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে চলে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে তা তো আমরা সবাই (পুলিশ ব্যাতীত?) দেখতে পাই পরিস্কার। সামপ্রতিক হানহানিতে যা দেখা যাচ্ছে তাতে এটিও এখন পরিষ্কার যে, গ্রামের মানুষদেরও রাজনৈতিক পক্ষ বিপক্ষ চিহ্নিত এবং সক্রিয় আছে। একজনের ভোট  চুরি/ডাকাতি করে নিয়ে যাবে অন্য জনে; অথচ প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখে পড়বে না, দেশ বিদেশে জানাজানি হবে না, সরকার গঠন পরিচালনায় তীব্র প্রতিকূলতায় পড়বে না, চিরতরে আস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হবে না এমন চিন্তা-ভাবনা এখন আর বাস্তব নয়। তাই রাজনীতিকদের পরিক্ষা রাজনীতিকদেরকেই দিতে দেওয়া উচিৎ। যাদের তত্ত্বাবদায়ক সরকারে যাওয়ার ইচ্ছা এবং সম্ভাবনা আছে তাদের অবশ্য পছন্দ হবে না আমার এই কথা। যাদের এই ইচ্ছা সম্ভাবনা নেই তারা দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনীতিকদের নিরপেক্ষতা পরীক্ষার হলে ডিউটি করার জন্য হওয়া উচিৎ ঐক্যবদ্ধ। যারা ফরম্যুলা দিচ্ছেন তাদেরও আসা উচিত এই ভাগে। সরকারের নিকট উত্থাপন করা উচিৎ এমন কিছু দাবি: () নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা হোক; () নির্বাচনের সচ্ছতা পর্যবেক্ষনের জন্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহ থেকে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিক আনার ব্যবস্থা পাকা করা হোক; () প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করার ব্যাবস্থা  নিশিচত করা হোক; () বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হোক ইত্যাদি। এইসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা কতটা ইতি বাচক বা নেতি বাচক তা থেকেই বুঝা যাবে  বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক এবং সেইসাথে বুঝা যাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন  কতটা যৌক্তিক। কার অধিনে অনুষ্ঠিত হবে
 
তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রতিটি ভালো মানুষই চায় অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। দুদিন আগে হোক আর পরে হোক, রাজনৈতিক সরকারকেই তো করতে হবে সেই কাজ। আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটি দিয়ে আর কতদিন আমরা তৈরি করবো  তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক পুতুল
মো. রহমত উল্লাহ্- শিক্ষাবিদ কলামিস্ট।
 
অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় কলেজ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment