Tuesday, August 13, 2013

নিয়মিত ও যুক্তিযুক্ত করা হোক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা


সোমবার, ১২ আগস্ট ২০১৩

নিয়মিত ও যুক্তিযুক্ত করা হোক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা
 মো. রহমত উল্লাহ্ 
ভোরের কাগজ : সোমবার, ১২ আগস্ট ২০১৩
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি মাসের বেতন-ভাতা দেয়া হয় পরের মাসের ১০/২০ তারিখে। পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী তথা প্রাতিষ্ঠানিক সচ্ছলতার অভাবে প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষকই পাচ্ছেন না প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা। বিশেষ দু-চারটি বিষয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক হয়তো করতে পারছেন টিউশনি। বাকি সবাই কেবলমাত্র সরকার থেকে প্রাপ্ত মূল বেতন + ৬০০ টাকা বাড়িভাড়া + ১৫০ টাকা চিকিৎসাভাতা মাত্র পেয়ে থাকেন।
এই দুর্মূল্যের বাজারে এতেই চালাতে হয় সংসারের সকল খরচ। দিতে হয় সন্তানের স্কুল/কলেজের বেতন, খাতা-কলম, কাপড়- পোশাক, চিকিৎসা খরচসহ নানামুখী নিয়মিত ও অনিয়মিত ব্যয়ের অর্থ। মাসের টাকায় মাস চলাই কঠিন। তার ওপরে দেড়/দুমাস চলবেন কিভাবে? এই যে এখন দেশীয় ফলের ভরা মৌসুম। সবাই ফল কিনছে, খাচ্ছে। ফল কি খেতে ইচ্ছে করে না বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের? কী দিয়ে ফল কিনবেন বেসরকারি শিক্ষকরা? যেখানে বাড়ি ভাড়ার জন্য তাগাদা করছে বাড়িওয়ালা। চাল ডাল লবণ তেল আর বাকিতে দিতে চাচ্ছে না মহল্লার মুদি দোকানি। অসুস্থ মা/বাবা/স্ত্রী/পুত্র/কন্যাকে দেখানো যাচ্ছে না ডাক্তার, দেয়া যাচ্ছে না জরুরি ওষুধ। কী বলে সান্ত¡না দেবে তাদের? এটি যে শুধু এবারকার ঘটনা তা নয়; প্রায় প্রতি বছরই মে মাসের বেতন-ভাতা জুলাই মাসে এবং নভেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পরের বছরের জানুয়ারি মাসে নিতে হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের। তদুপরি ঈদের/পূজার আগে নিয়মিত দেয়া হয় না তাদের প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও বোনাস। নতুন জামা কিনতে ইচ্ছে করে না বুঝি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের? শেষ পর্যন্ত কমমূল্যে বেতনের চেক বিক্রি করে কোনোভাবে পার করতে হয় পূজা/ঈদ, এমন খবর অনেক দিনের। তখন কী যে কষ্টের হয় সেই পূজা/ঈদের আনন্দ, তা কি বুঝতে পারেন আমাদের সরকার ও সমাজপতিরা? যুগ যুগ ধরে এমনিভাবে অবহেলিত আমাদের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা! আগের তুলনায় কিছুটা নিয়মিত হলেও সরকারিদের মতো প্রতি মাসের বেতন-ভাতা পরের মাসের ১/২ তারিখে পাচ্ছেন না বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। ঈদের/পূজার আগে হাতে পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা এখনো তৈরি হয়নি উৎসব ভাতা বাবদ প্রাপ্য নামমাত্র টাকা।

অনেকেই বলে থাকেন সরকার ও সরকারি ব্যাংক ইচ্ছে করেই পরিকল্পিতভাবে প্রতি বছর মে মাসের বেতন জুলাই মাসে এবং নভেম্বর মাসের বেতন পরের বছরের জানুয়ারি মাসে দিয়ে থাকে। এতে করে অর্থবছর ও পঞ্জিকা-বছরের শেষ দিনে অর্থাৎ জুন মাসের ৩০ তারিখে এবং ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমার পরিমাণ বেশি থাকে। আর এই জমার পরিমাণ বেশি থাকার কৃতিত্ব দেখিয়ে সরকারি ব্যাংকাররা টার্গেট বোনাস পেয়ে থাকেন। অবস্থাদৃষ্টে মনেও হয় এমনটি। এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে কেমন নিষ্ঠুর এই ব্যক্তিরা? তাদের যারা পড়িয়েছেন, তাদের সন্তানদের যারা পড়াচ্ছেন সেই শিক্ষকদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক আটকে রেখে, তাদের উপোস রেখে, কষ্টে রেখে কিভাবে পারেন তারা ভালো থাকতে? তাদের বোনাস পাবার প্রয়োজনে যদি বছরের কোনো এক/দুদিন ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতেই হয়, তো ব্যাংকাররা নিজেরা দু-চার মাস বেতন উত্তোলন না করলেই পারেন। তারা তো সংখ্যায় কম নন। তাদের বেতনের পরিমাণও তো বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া বেসরকারিদের মতো সরকারিদের বেতন-ভাতাও ব্যাংকে জমা থাকতে পারে দু-এক মাস। তাতে ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ এবং বোনাসের পরিমাণ আরো বেশি হবে না কি? এটি যদি সত্য না হয়, তো কেন বেসরকারি শিক্ষকরা সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা না পেয়ে অনটনে কষ্ট পাচ্ছেন বারবার, তাকি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নেই সরকারের? যাদের কারণে বিলম্বে বেতন প্রদানের দায়ে বারবার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে সরকারের, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্রমাণ করা উচিত নয়কি সরকারের সদিচ্ছা? এই বিপুল সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন-ভাতা সঠিকভাবে বণ্টনে যদি সরকারি ২/৩টি ব্যাংক এমনিভাবে বারবার ব্যর্থতা বা অবহেলা দেখায়, তাহলে তাদের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বণ্টন করতে অসুবিধা কোথায়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবিধা/চাহিদা অনুসারে ব্যাংক ও ব্যাংকের শাখা নির্ধারণ করে শিক্ষকদের কিছুটা মুক্ত করা যায় না সরকারি ব্যাংকারদের অবহেলা ও হয়রানি থেকে?

বর্তমান সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করা হবে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেল তো শুরু থেকেই একরকম স্বতন্ত্র। তাদের একসময় সরকার থেকে দেয়া হতো না কিছুই। পরে দেয়া শুরু হলো ৫০%, ৬০%, ৭০%, ৮০%, ৯০% অনুদান/বেতন। বর্তমানে দেয়া হচ্ছে ১০০% বেতন, ৬০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৫০ টাকা চিকিৎসাভাতা আর ২৫% / ৫০% বোনাস, সারা জীবনে একটা ইনক্রিমেন্ট! বর্তমান সরকার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করেছেন। যা সন্তোষজনক না হলেও পূর্বের ১০০ টাকার তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। উৎসব ভাতাও ২৫% এবং ৫০% এর স্থলে সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০% প্রদান করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। উৎসব তো সবার জন্যই সমান। প্রথমে তো প্রয়োজন এসব বৈষম্য নিরসন করা। উৎসবের আগেই প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন তাদের প্রাপ্য বোনাস ও ভাতাদি। তদুপরি সরকারিদের মতোই নিশ্চিত করতে হবে প্রতি মাসের ১/২ তারিখে প্রাপ্য বেতন-ভাতা প্রদান। যা দিতে হবে, তা সময় মতো দিয়েই নিতে হবে ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাক্ষেত্রে যতোটুকু অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী, তাতে অনেক বেড়েছে শিক্ষকদের আশা ও বিশ্বাস। তিনি বারবার বলছেন, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের সহায়ক ভূমিকা। তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, শিক্ষকদের প্রতি তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক। আশা করি আমরা শিগগিরই বাস্তবে দেখতে পাবো তার এই আন্তরিকতার প্রমাণ। দূর হবে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের কষ্ট। ভুলে গেলে চলবে না যে, বেসরকারি শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন দেশের প্রায় ৯৫% শিক্ষার্থী এবং সেই সুবাদে তাদের সুখ-দুঃখের সাথী এদেশের সর্বাধিক নাগরিক।

মো. রহমত উল্লাহ্ : প্রিন্সিপাল, কিশলয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment