Sunday, April 20, 2014

সার্বিক সাক্ষরতার হার বাড়বে কিভাবে

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১০

সার্বিক সাক্ষরতার হার  বাড়বে কিভাবে
 অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্

‘মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নিরক্ষর মুক্ত করা হবে’(ইত্তেফাক রিপোর্ট- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১০)। এটি বাঙালি জাতির জন্য অব্যশ্যই একটি সুখবর! আমাদের সবাইকে নূন্যতম অক্ষর জ্ঞান দান করে, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করার নামে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বা কর্মসূচী বাস্তবায়নের পিছনে এ যাবৎ ব্যয় হয়েছে সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থাগুলোর বিপুল অর্থ, শ্রম এবং সময়। আজো আমরা মুক্ত নয় সেই অভিশাপ থেকে।
যদিও অনেকের মতে এসকল পদক্ষেপের কারণেই শিক্ষার হার বেড়ে হয়েছে ৬২.৬৬ শতাংশ (সূত্র- অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯ এবং  প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)। এসব কর্মসূচীর মাধ্যমে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষা সচেতনতা। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে ড্রপ আউটের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশের নিচে। সময়, শ্রম ও অর্থব্যয়ের তুলনায় এই অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যালট পেপারের মুড়িতে ভোটারদের টিপসহির পরিমাণ দেখে এই হিসাবের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হয়ত  নিন্দুকেরা বলে থাকেন, আমাদের নিরক্ষরতা জাতির জন্য অভিশাপ হলেও কারো কারো বিদেশি অর্থ পাওয়ার ও খাওয়ার জন্য হয়ত এটি বড় আশির্বাদ!

আসলে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বয়স্কদের অনাগ্রহ বা অলসতাই অশিক্ষার অন্যতম কারণ। অসচেতনতা ও অসচ্ছলতা তো আছেই। তদুপরি নেই কোন বাধ্যবাদকতা। নূন্যতম  লেখাপড়া না জানার দায়ে বড় কোন সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন বলে মনে করছেন না নিরক্ষরগণ। কেননা, তারা ব্যক্তিগত  জৈবিক ও বৈষয়িক সমস্যাকেই বড় করে দেখেন অশিক্ষার অন্ধকার চোখে। তাই তাদের প্রত্যেককে কোন না কোন ভাবে বাধ্য করতে হবে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করতে। বুঝিয়ে দিতে হবে, শিক্ষা গ্রহণ ব্যতীত অচল হয়ে যাবে তার জীবনযাপন। কেননা, কাউকে কোন কিছু শিক্ষা দেয়া যায় না, যদি সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে না আসে। একটি সরকারি পদক্ষেপই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ: সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১-৮২ সালের এস.এস.সি. পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ৫০ নম্বর পুরস্কার দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন নিরক্ষরদেরকে অক্ষর জ্ঞান দেয়ার জন্য। পরীক্ষার্থীরা প্রথমে মনের আনন্দে এবং পরে বাধ্য হয়ে বার বার গিয়েছে নিরক্ষরদের বাড়ি বাড়ি। তখন আমি নিজেই শুনেছি নিরক্ষরদের মন্তব্য “আমি লেখা-পড়া শিখলে তুমি নম্বর পাইবা আমি কী পামু ?” এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে কিশোর পরীক্ষার্থীরা। নম্বর পাওয়ার তাগিদে (দুই/এক রোজের পারিশ্রমিক দিয়ে বা অন্য কোন ভাবে) সামান্য লেখা পড়া জানে এমন লোকদেরকে হাজির  করেছে স্যারদের সামনে। মিথ্যে করে বলেছে- উনাকে আমি লেখা-পড়া শিখিয়েছি। নম্বর পেয়ে গেছে পরীক্ষায়। আসলে যে নিরক্ষর সে পায়নি বা নেয়নি অক্ষর জ্ঞান। চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে অত্যন্ত মিতব্যয়ী একটি পদক্ষেপ। এছাড়াও সম্ভব হয়নি দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচি ও নিজেদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ প্রকল্পের প্রকৃত সফলতা অর্জন। সেখানেও ছিল নিরক্ষরদের আগ্রহ তৈরির ব্যর্থতা। শিক্ষা লাভের জন্য বয়স্কদেরকে আমরা নিতে পারিনি সেই নাইট স্কুেল বা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে। সকল শিশুকে নিতে পারিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমরা হয়ত মনে রাখিনি যে, শিখন একটি দ্বিমুখী প্রকৃয়া। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের আন্তরিকতার উপরই নির্ভর করে এর সফলতা।

আলোচিত বাস্তবতার আলোকে দেখাযায় সার্বিক সাক্ষরতা অর্জন দ্র“ত ও নিশ্চিত করতে চাইলে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি নিম্নরূপ দু‘একটি আইন বা আদেশ জারি করা জর“রি। যেমন: বিয়ের  বর, কণে ও স্বাক্ষি হতে হলে; যে কোন দলিলের দাতা, গ্রহীতা ও স্বাক্ষি হতে হলে; কোন মামলার বাদি, বিবাদি বা স্বাক্ষি হিসাবে আদালতে জবানবন্দি দিতে গেলে; ব্যাংক বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গেলে;  যে কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে ও ভোট দিতে চাইলে; যে কোন প্রতিষ্ঠানে যে কোন পদে চাকরি প্রার্থী হলে; নিজের বা অন্যের পেনশনের টাকা পেতে হলে;
কোনরূপ সরকারি সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলে; বিদেশ যেতে চাইলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের এমন শিক্ষা থাকতে হবে যাতে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পড়ে ও বুঝে নিজের ‘নাম স্বাক্ষর’ দিতে পারেন, টিপ সহির পাশাপাশি। শুনতে ও মানতে একটু কঠিন মনে হলেও সত্যিকারার্থে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নিরক্ষর মুক্ত করতে হলে এখই জারি করতে হবে উল্লিখিত আদেশ, যা কার্যকর করতে হবে ২০১৫ সালের শুর“তে। তবে শিশু, প্রতিবন্ধি ও অতি বৃদ্ধদেরকে মানবিক কারণেই রাখতে হবে এই আইনের বাইরে।

দেশ নিরক্ষর মুক্ত হয়ে গেলে এ খাতে আর বিদেশী ‘ভিক্ষা’ পাওয়া যাবেনা, ভাগ-বণ্টনও করা যাবে না; অতএব এমনি চলুক! যারা এই অশুভ মনোভাব পোষণ করে তারা অবশ্য আমার এই উচিত কথায় মনক্ষুন্ন হয়ে বিভিন্ন সমালোচনা করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের বাধ্যবাদকতা দ্বারা নিরক্ষরদের শিখার আগ্রহ নিশ্চিত করা যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমরা  উপদেশের চেয়ে কড়া নির্দেশই মান্য করি বেশি। তবে আমার বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, শুধু আইন করে দিলেই নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। বরং সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই হোক আর ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই হোক ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, চাকুরে, গৃহিনী, ইমাম, সমাজকর্মী, খেলোয়ার, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল শিক্ষিত ব্যক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে উদার মন নিয়ে। একজনকে নিতে হবে কমপক্ষে একজনের দায়িত্ব। কাজের লোক বলে, দরিদ্র বলে, ভিক্ষুক বলে নিরক্ষরদের প্রতি কোন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা নয়; বরং শ্রদ্ধাভরে টেনে নিতে হবে কাছে। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে দিতে হবে শিক্ষা। আবারও প্রমান করতে হবে-  ‘আমরাও পারি’। তবেই সম্পাদিত হবে পূণ্যকর্ম। তৈরি হবে সত্যিকার নিরক্ষরমুক্ত বাঙালি জাতি। বিশ্বদরবারে বৃদ্ধি পাবে আমাদের প্রকৃত গৌরব। //
[লেখক- অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।]

No comments:

Post a Comment