Monday, April 21, 2014

পাবলিক টক-শো-৩ : বিষয় : গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন



 ২৩/১২/২০১৩
পাবলিক টক-শো-৩ : বিষয় : গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন
মো. রহমত উল্লাহ
ভোরের কাগজ : ২৩/১২/২০১৩
ক: কী খবর দোস্ত?
খ: আছিতো ভালোই। তোমার কী খবর? কেমন আছো? এখনতো ভালোই থাকবা দোস্ত, তোমাদের সরকার ক্ষমতায়।
ক: ভালো থাকতে আর দিলা কই? তোমাদের আপোসহীন নেত্রীর হরতাল অবরোধের ঠেলায় আজকে শুক্রবারেও বাচ্চাদের পরীক্ষা। লেখাপড়ার তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছো এবার। আসো বসি এক জায়গায়।

খ: ঠিক আছে, চলো, চা খাই। থাকতেতো হবে তিন ঘণ্টা। ভালোই হলো, শুক্রবারে পরীক্ষা না হলে কি আর আমাদের দেখা হতো বার বার। যা শুরু করছো তোমরা। অবরোধ না দিয়ে উপায় কী? এই ভাবে পুলিশ দিয়ে মানুষ মেরে আর কতোদিন টিকা যায়? আমাদের মারতে মারতে এখনতো দেখি তোমাদেরকেও মারছে! মনে হয় সরকারের কোথাও আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গণজাগরণের লোক তো তোমাদেরই লোক। তোমরাইতো তৈরি করলা এই গণজাগরণ। এখন তোমরাই পিটাচ্ছো। আগে না করে দিলেই তো পারতা, তোমরা পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করতে যেও না।
ক: আর বলো না, এই গুলো হচ্ছে অতি ইমোশনাল ইমমেচিউর্ডের দল। অনেকেরই ধারণা এরা মহাজোটের দ্বারা পরিচালিত। আসলে এরা কারো কথা শুনে না। নিজেরা যখন যা বোঝে তাই করে। খেয়াল করো, কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে প্রথম বার যখন তারা শাহবাগে জমা হলো, সবাইতো তাদের সমর্থন করেছেন। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমারও ইচ্ছা করে তোমাদের সঙ্গে যেয়ে যোগ দিই। তোমরা শিক্ষার্থী। এখন ঘরে ফিরে যাও। লেখাপড়ায় মন দাও। তারা কি প্রধান মন্ত্রীর সেই কথা শুনেছিল? তারা যদি তখন ফিরে যেতো, তো তাদের শক্তিটা অটোট থাকতো। তারা রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ চায়। হাসিনা সরকারেরতো এটা নির্বাচনী অঙ্গীকার। এতোদিন পর যখন কাদের মোল্লার বিচার হলো, ফাঁসি হলো তখন কি গণজাগরণ মঞ্চ ছিল? তারা যেভাবে আল্টিমেটাম দিচ্ছে সেভাবে কি সবকিছু করা যায়? কারো আন্দোলনে কি আদালতে বিচার কাজ চলতে পারে। তারা শাহাবাগে বসে থেকে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় করিয়ে, কার্যকর করে তারপর ঘরে ফিরে যাবে! এটা কি কোনো বাস্তব কথা হলো? এমনিতেইতো এই বিচারের বিপক্ষে হাজারো বিতর্ক, হাজারো প্রতিকূলতা। আবার তাদের আল্টিমেটাম অনুসারে কিছু করা হলে সেটাতো আরো বিতর্কিত হতো। তাদের এই একতা, উদ্যোগ, আন্দোলন সবইতো মহাজোটের প্রত্যাশিত। শেখ হাসিনাতো মনে হয় অপেক্ষাই করছিলেন এমন একটি গণজাগরণের। তারা যদি প্রধান মন্ত্রীর কথায় সেদিন শাহাবাগ ছেড়ে যেতো, তো তাদের নিয়েও এতো কিছু হতো না। হেফাজতকে রাস্তায় নামানোর জন্যতো তারাই দায়ী। এই হেফাজত সামলাতে গিয়ে কতটা যে ক্ষতি হয়েছে মহাজোট সরকারের তা কি তারা বোঝে? মাদ্রসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার লক্ষে যেই মাওলানা সফিকে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান করলো এই সরকার সেই সফি শেষে মিলে গেলো বিএনপি জামাতের সঙ্গে। গণজাগরণ কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা আর নিরাপত্তা দিতে দিতে নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হলো সরকার। এতো উন্নয়ন করার পরেও হঠাৎ ধস নামলো জনপ্রিয়তায়। সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে নেমে আসলো চরম পরাজয়। নতুন করে মাথাচারা দিয়ে উঠলো বিএনপি জামাত। এতো দফার কী দরকার ছিল তাদের? ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।’ এই একটা দফাইতো যথেষ্ট ছিল। এটাইতো অনেক বড় কাজ, অনেক কঠিন কাজ। এটা শেষ হলে তার পর অন্য কথা। না, তারা একবারে সব খাবে। হজম করতে পারবে কি না তা কি তারা জানে? জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিসিদ্ধ করতে হবে। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। অর্থের সকল উৎস বন্ধ করতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকের এই দিনে এসে এর এক একটি কাজ কতো যে কঠিন, কতো যে সময়ের ব্যাপার, তা কি তারা বোঝে? এইসব বাড়তি কথা বলেইতো খেপিয়ে দিয়েছে শিবির। জামাত-শিবির যখন বোঝতে পারছে তাদের বিদেশী আয় থাকবে না, ভাতা থাকবে না, লেখাপড়া চলবে না, প্রতিষ্ঠান থকবে না, নিজেদের চাকরি থাকবে না, সন্তানদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে না; তখনইতো তারা মরিয়া। তারাকি সবাই কাদের মোল্লার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে এইসব করছে? কাদের মোল্লার ফাঁসি তো হলো একটা ইস্যু মাত্র। তারা লড়ছে মরছে মারছে নিজেদের লাভে। এই যে সেদিন গণজাগরণের কর্মীরা পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও করতে গেলো। তারা কি তাদের সব কর্মী-সমর্থদের নাম ঠিকানা জানে? প্রতিবাদ করবে ভালো কথা। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাক। রাস্তায় মিছিল করুক। দূতাবাস এলাকায় যাওয়ার দরকার কী? তাদের ভিতরে জামাত শিবিরের লোক ঢুকে অন্যান্য দূতাবাসে দুএকটা পেট্রলবোমা মেরে দিলে এর দায় দায়িত্ব নেবে কে? তারা কি জানে না, দেখে না, সারাদেশে এখন বোমার ছড়াছড়ি? বিশ ঘণ্টার আল্টিমেটাম। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এটি কি এতোই সহজ ও স্বল্প সময়ের কাজ? এটিতো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। পাকিস্তানের কি আর বন্ধু রাষ্ট্র নেই? তারা সবাই যদি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তখন কী হবে? এইসব কি তারা চিন্তা করে? এইসব করে তারাতো সরকারকে আরো বেকায়দায় ফেলছে বার বার। সরকার নিজেই এখন টালমাটাল অবস্থায়।
খ: তাহলে সরকার তাদের পাহারা দেয় কেনো? শাহাবাগের রাস্তা দখল করে বসে থাকে কয়েক দিন পর পর। সরকারের পুলিশ দিয়ে তাদের পাহাড়া না দিলে একমিনিট টিকতে পারবে? এইসব হারমোনি তবলা দিয়ে কি মোকাবিলা করতে পারবে পেট্রলবোমা? সারাদেশে কয়টা ভোট আছে তাদের? তাদের কথায়ইতো সরকার কাদের মোল্লারে ফাঁসি দিলো।
ক: সরকার ফাঁসি দিবার কে? ফাঁসি দিয়েছে উচ্চতর আদালত। কাদের মোল্লা রাজাকার, খুনি, ধর্ষণকারী, তারে ফাঁসি দেবে না তো আদর করবে? সে যে আসলে পাকিস্তানি, পাকিস্তানের সরকারই এখন তা প্রমাণ করেছে! যে বাংলাদেশ মানে না তার জন্য দরদ দেখানোর কী আছে? যেই দল বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না সেই দলের কী অধিকার আছে এখানে রাজনীতি করার? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এটা আমাদের আত্মমর্যাদার বিষয়। এখানে চুপ করে থাকা অপরাধ। দুঃখজনক হচ্ছে তোমাদের বিএনপি নেতারা এ ব্যাপারে কিছুই বললো না! বিএনপি যদি তাদের পক্ষ না নিতো তাহলে তারা এতোটা বাড়াবাড়ি করতে পারতো না। কিছু জ্ঞান পাপিও আছে তাদের পক্ষে। গণজাগরণের কর্মীরাতো ৃ
খ: গণজাগরণের তারা বললেই তো হয়, বিএনপির আর কী বলা দরকার? এতোদিন আগের বিষয় নিয়ে এখন টানাটানি করে লাভ কী? এই সব গণজাগরণ করে দেশে অশান্তি বাড়ানো ছাড়া আর কী হবে? শুধু শুধু দেশে বিভেদৃ
গ: আপনাদের মতো কিছু লোক আছে বলেই আমরা আজ এতো ভাগে বিভক্ত! মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এইসব কোনোদিন পুরাতন হয় না। আসলে আমাদের যুদ্ধ শেষ না হয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী যদি এতো তাড়াতাড়ি না আসতো, আরো কয়েক বছর যুদ্ধ চলতো, আমরা আমাদের সকল শত্রু হনন করে দেশ স্বাধীন করতাম, তাহলে এইসব রাজাকার বেঁচে থাকতো না। আজকের এই গণজাগরণের প্রয়োজন পড়তো না। সেই অসমাপ্ত যুদ্ধ সমাপ্ত করার জন্যইতো এখন প্রয়োজন গণজাগরণ। আপনাদের তো বয়স কম। ছেলেমেয়েরা মাত্র স্কুলে পড়ে। আমার নাতি-নাতনিরাও আপনাদের ছেলেমেয়েদের সমান। একাত্তরে আপনাদের বয়স আর কতো ছিল? আপনারা নিজেরা নিশ্চয়ই যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ দেখলেও তা বোঝেননি। সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ পাননি। সঠিকটা জানতেও চান না, মানতেও চান না। জিয়াউর রহমানইতো বাঙালি বাংলাদেশী বলে আমাদেরকে দুইভাগ করে গেছেন। রাজাকারদের রাজনীতি করার অধিকার দিয়ে গেছেন। এতোক্ষণ যা শুনলাম, আপনারা দুই বন্ধুইতো পরিষ্কার দুইভাগ। এইরকম দুইভাগে বিভক্ত সারাদেশের মানুষ। একভাগ বড় আর একভাগ ছোট। এখন একে অপরের মুখামুখি। বিশ্বের কোথাও এমন নেই যে, নিজেদের দেশ, জাতি ও স্বাধীনতার ব্যাপারে নাগরিকগণ দুইভাগে বিভক্ত! এখনতো একভাগ হওয়ার প্রশ্ন। হয় একভাগ হবে, না হয় অস্তিত্ব বিলীন হবে। আমরা যারা মন থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারাতো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না এই অবস্থা। গণজগরণ মঞ্চের উত্থান দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের অসমাপ্ত যুদ্ধটা তারা শেষ করতে পারবে। কিন্তু তাদের অপরিপক্বতা আমাদের হতাশ করছে বার বার। যে আন্দোলনের নেতা নেই সে আন্দোলনের সফলতা নেই। যে নেতার বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা নেই, দূরদৃষ্টি নেই, সঠিক পরিকল্পনা নেই, কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই সে নেতার বেশিদূর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই গণজাগরণকে জিইয়ে রাখা, সম্প্রসারণ করা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন খুবই জরুরি। এগিয়ে যেতে হবে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কভাবে, সুসংগঠিতভাবে। যাতে ছিটকে পড়তে না হয় বিরোধীরা ক্ষমতায় এলেও। খুবই সাবধান থাকতে হবে ধর্মীয় ব্যাপারে। যার জন্য প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। জানি আমাদের এইসব কথা ভালো লাগবে না আপনাদের কারো কারো। সঠিক ইতিহাস জানেন। সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় বোঝতে এবং মানতে ৃ ।
[গত ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে ঢাকার একটি স্কুলে পরীক্ষা চলাকালে বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের কয়েকজনের মধ্যে চলমান বিভিন্ন বিতর্কের অংশবিশেষ।]
মো. রহমত উল্লাহ : শিক্ষক, লেখক।

No comments:

Post a Comment