বর্তমান বাজেটেই দ্বিগুণ করা সম্ভব কলেজ শিক্ষকদের
বেতন-ভাতা
মো. রহমত উল্লাহ
ভোরের কাগজ : ১৩/১০/২০১৪ http://www.bhorerkagoj.net/
প্রতিবারই এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল
প্রকাশিত হওয়ার পরপর একটি খবর প্রকাশিত হয়। ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না
ভালো শিক্ষার্থীরা। যে হারে এ+ পাচ্ছে, এতো এ+ কলেজ পাবে কই? এ+
শিক্ষার্থীরাতো এ+ কলেজে ভর্তি হতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন কলেজে
ভর্তির সুযোগ পাবে না আমাদের ছেলেমেয়েরা? আমাদের কি কলেজ কম? কলেজে কি
শিক্ষক কম? মোটেও
না। বরং শিক্ষার্থীর তুলনায় অনেক বেশি কলেজ, অনেক বেশি শিক্ষক। কি, পাঠক, খটকা লাগছে?
তা তো লাগবেই।
স্রোতের বিপরীতে কথা বলছি আমি। একটু লক্ষ করুন, কলেজে ভর্তির কতো কতো বিজ্ঞাপন আপনার
আশপাশে। চাহিদা ও জোগান তত্ত্ব অনুসারে কলেজর সংখ্যা কম হলে তো মোটেও প্রয়োজন
হতো না এতো এতো বিজ্ঞাপনের। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ছুটতে হতো না কলেজের
শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীর অভাবে স্বীকৃতি নবায়ন ঝুলে থাকতো না হাজার হাজার নতুন
পুরাতন কলেজের।
তা হলে কি বলা যায়, কলেজ আছে;
কিন্তু ভালো
কলেজ নেই। এ+ সনদধারীদের জন্য এ+ কলেজের অভাব। ভালো কলেজ কোনটি? প্রচলিত
ধারণায় বলা যায়, যে
কলেজে বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে সেটিই ভালো কলেজ।
সেখানে কার কৃতিত্ব বেশি; সেই কলেজের শিক্ষকদের, নাকি বাছাই করা শিক্ষার্থীদের, নাকি লাগাতার
কোচিংয়ের সেটি আলোচনা করতে গেলেই হয়তো রাগ করবেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং সেই
ভালো কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক। অথচ সেইসব ভালো কলেজে আনুপাতিক হারে এ,
বি, সি গ্রেডের
কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি করে দিলেই দেখা যেতে পারতো তারা কতোটা ভালো পড়ান। কিন্তু
সরকার তা না করে, ভালো
কলেজ ঘোষণা দিয়ে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের শিক্ষা বাণিজ্যের সুযোগ। তদুপরি তাদের
নতুন নতুন সেকশন ও শাখা খোলার সুযোগ দিয়ে অন্যান্য কলেজে তৈরি করছে শিক্ষার্থী
সংকট।
এমন অনেক সরকারি-বেসরকারি কলেজ আছে,
যেখানে ১৫/২০
জন শিক্ষক, ৪০/৫০
জন শিক্ষার্থী। অনেক কলেজে এমন বিভাগ আছে, যেখানে ৫/৭ জন শিক্ষার্থী, ৮/১০ জন
শিক্ষক। অধিকাংশ কলেজে এমন এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে শিক্ষক আছেন ঠিকই, কিন্তু
শিক্ষার্থী ২/১ জন আছে অথবা নেই। সেই কলেজগুলো কি সরকারের অনুমোদিত নয়? সেইসব কলেজের
শিক্ষকদেরও তো সরকার কম/বেশি বেতন দিচ্ছে। তাদের রক্ষা করা কি সরকারের দায়িত্ব
নয়? তাহলে কেন
তৈরি করা হচ্ছে বা অনুমোদন দেয়া হচ্ছে আরো নতুন নতুন কলেজ?
সরকার বার বার বলছে শিক্ষকদের বেতন
বাড়ানো উচিত এবং স্বতন্ত্র স্কেল দিয়ে তা বাড়ানো হবে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। এ
কথা সত্য যে শিক্ষা খাতে কর্মরত লোকের সংখ্যা অন্যান্য বিভাগের চেয়ে বেশি। তাই এ
খাতে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সামান্য বাড়াতে গেলেই অনেক টাকার
প্রয়োজন। তবে এ কথাও তো সত্য যে, শিক্ষা খাতে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে দেশের
সবচেয়ে বেশি দীর্ঘমেয়াদি ও লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা। উন্নত বিশ্বের সব দেশেই
শিক্ষকগণের বেতন-ভাতা সর্বাধিক। যারা এ খাতে বিনিয়োগ যতো বেশি বাড়িছেন তারা ততো
বেশি উন্নতি লাভ করেছেন। তবে এই বিনিয়োগ হতে হয় সুপরিকল্পিত। অথচ একদিকে আমাদের
রয়েছে অনটন, অপরদিকে
রয়েছে অর্থের অপচয়। রয়েছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। যেমন আমাদের দেশে কলেজ পর্যায়ে
শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় এই অতিরিক্ত শিক্ষক
না থাকলে বর্তমান বাজেটেই প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব কলেজ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা।
একটু লক্ষ করা যাক কেমন করে তা সম্ভব। বর্তমানে প্রায় উপজেলাতেই উচ্চমাধ্যমিক
পর্যায়ের ৮/১০ করে সরকারি এমপিওভুক্ত সাধারণ কলেজ, কারিগরি কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসা
রয়েছে। যাদের প্রায় প্রতিটিতেই (কোনো কোনো উপজেলার ১/২ বিশেষ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত)
রয়েছে মানবিক, বিজ্ঞান
ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে গড়ে ৫০ থেকে ৭০ জন
শিক্ষার্থী এবং ১৫ থেকে ১৮ জন শিক্ষক। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩/৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য
রয়েছেন ১ জন করে শিক্ষক। এই সব প্রতিষ্ঠানে এমনও বিষয় রয়েছে যে বিষয়ের শিক্ষক
আছেন কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী নেই। যেমন আইসিটি বিষয় সব বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য
বাধ্যতামূলক করার ফলে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের সাচিবিক বিদ্যা বিষয়ের শিক্ষার্থী
এখন শূন্যের কোটায়। এসব প্রতিষ্ঠানের মানবিক বিভাগের ১৫/২০ শিক্ষার্থী আইসিটি,
ইতিহাস,
ইসলামের
ইতিহাস, ইসলামিক
স্টাডিজ, অর্থনীতি,
পৌরনীতি,
সমাজকর্ম,
ভূগোল,
কৃষি শিক্ষা,
গার্হস্থ্য
বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান
ইত্যাদি বিষয়ে ভাগাভাগি হয়ে কোনো কোনো শিক্ষকের ভাগে একজনও পড়ে না বাস্তবে।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তো সারা দেশেই কম। আর এই সব কলেজ-মাদ্রাসায় তো
নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থী সংকটের এই করুণ চিত্র যে কেবল মফস্বলের তা কিন্তু নয়;
রাজধানী
ঢাকাসহ প্রতিটি শহরের প্রতিটি থানায়ই রয়েছে এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার্থী সংকট সম্পর্কে আমার এই বক্তব্যের প্রমাণ হচ্ছে, কাম্য
শিক্ষার্থী না থাকার দায়ে এইরূপ হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি
নবায়নের আবেদন বছরের পর বছর শিক্ষা বোর্ড অফিসে ঝুলে আছে। অথচ এইসব শিক্ষকদের
বছরের পর বছর বেতন-ভাতা দিয়ে যাচ্ছে সরকার; তা যতো কমই হোক না কেন। তদুপরি
প্রতিটি উপজেলায় হিড়িক পড়েছে ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স কলেজ করার। অধিকাংশ
প্রতিষ্ঠানে বিষয় খোলা হচ্ছে নিজেদের বেকার স্বজনদের চাকরির কথা বিবেচনা করে।
শিক্ষার্থী থাকুক চাই না থাকুক, নিজের বা দলের মানুষের চাকরি হলেই হলো। বেতন দেবে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় করে দিবেন প্রতিটি জেলায়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়েই তো
লেখাপড়া করতে পারে ১০/১৫ হাজার শিক্ষার্থী। তার ওপর এতো এতো কলেজে উচ্চ শিক্ষা।
সবাই উচ্চ শিক্ষা নিলে কারিগরি কলেজে পড়বে কারা? একটা জেলা বা উপজেলা থেকে কতোজন কোন
বিষয়ে অনার্স দরকার, কতোজন ডাক্তার দরকার, কতোজন ইঞ্জিনিয়ার দরকার, কতোজন পিএইচডি
দরকার, কতোজন
আলেম দরকার, কতোজন
মুফতি দরকার, কতোজন
কৃষিবিদ দরকার, কতোজন
পুষ্টিবিদ দরকার, কতোজন
নার্স দরকার, কতোজন
শিক্ষক দরকার, কতোজন
কারিগর দরকার এবং এই চাহিদা মিটানোর জন্য কতোটি কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
দরকার তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এই হিসাব-নিকাশ
করেই তৈরি করা বা অনুমোদন দেয়া দরকার নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। উন্নত
বিশ্বে তাই হয়ে থাকে। অন্যথায় শিক্ষা খাতে অর্থ ব্যয় লাভজনক বিনিয়োগ না হয়ে হবে
ক্ষতিজনক অপচয়।
অথচ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একাধিক
বিভাগ ও বিভাগের বিষয় না খুলে একেকটি উপজেলায়/থানায় প্রয়োজন বা চাহিদা অনুসারে
বিশেষায়িত করে ছোট/বড় একটি সাইন্স কলেজ, একটি আর্টস কলেজ, একটি কারিগরি
কলেজ ও দুএকটি কমার্স কলেজ থাকলে অর্ধেকেরও কম সংখ্যক ভালো শিক্ষক দিয়েই
সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব বর্তমান সংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া। সেখানেই হতে
পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উচ্চ শিক্ষা। সরকার সে দিকে যাওয়ার চেষ্টা তো করছেই না
বরং অন্যান্য কলেজের পাশে তৈরি করছে আরো নতুন নতুন কলেজ এবং সেই সব কলেজগুলোকে
বিশেষায়িত না করে খুলে দিচ্ছে সব বিভাগ। অথচ পরিকল্পিতভাবে বিশেষায়িত কলেজ করে
এবং বিদ্যমান কলেজগুলোকে সময় ও অপশন (ঙঢ়ঃরড়হ) দিয়ে বিশেষায়িত করার সুযোগ
প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান বাজেটেই দ্বিগুণ করা সম্ভব কলেজ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা।
বর্তমান উন্নয়ন বাজেটের টাকা দিয়েই দেয়া সম্ভব পর্যাপ্ত আধুনিক ভবন, আসবাবপত্র,
ই-লাইব্রেরি,
ডিজিটাল
ক্লাসরুম ও সব অত্যাধুনিক শিক্ষা সামগ্রী। প্রতিটি কলেজই হতে পারে ভালো কলেজ।
আরো বেশি নিশ্চিত হতে পারে মানসম্পন্ন শিক্ষা।
মো. রহমত উল্লাহ : শিক্ষক, লেখক।
|
Thanks for the writings.
ReplyDeleteWow!
ReplyDelete