Saturday, March 19, 2016

শিক্ষার্থীদের টিসি বিষয়ক হয়রানি আর কতদিন

শিক্ষার্থীদের টিসি বিষয়ক হয়রানি আর কতদিন

দৈনিক ইত্তেফাক, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
শিক্ষার্থীদের টিসি বিষয়ক হয়রানি আর কতদিন

মো. রহমত উল্লাহ


বিভিন্ন কারণে প্রায় সারাবছর ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বাবা -মায়ের বদলিযোগ্য চাকরির কারণে এবং আরো ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ইচ্ছায় বার বার বদল করে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বদল যে কেবল শিক্ষা বর্ষের শুরুতেই হয় তা নয়। বছরের প্রথমার্ধে, মাঝামাঝিতে, শেষার্ধে তথা যেকোনো সময় হতে পারে।

এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় কোনো শিক্ষার্থী যদি বছরের মাঝামাঝি অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে একই শ্রেণিতে ভর্তি হতে চায় তো তার বর্তমান প্রতিষ্ঠান থেকে টিসি নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। কেননা সে এই শেণিতে বর্তমানে পড়ছে এর প্রমাণ হচ্ছে টিসি। সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রতিষ্ঠানে যে মাস পর্যন্ত বেতন-ফি পরিশোধ করে যায় তার পরের মাস থেকে নতুন প্রতিষ্ঠান বেতন-ফি চার্জ করা যুক্তিযুক্ত হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। শিক্ষার্থীদের অতি তাগিদে যেহেতু নতুন প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে সেহেতু তাদের জিম্মি করে বছরের শুরু থেকে হিসাব করে সকল ফি আদায় করছে তার নতুন প্রতিষ্ঠান। তদুপরি এমনও হয় যে, তার ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের শেষদিন পর্যন্ত বেতন-ফি আদায় না করে টিসি দিতে চায় না। ফলে একজন শিক্ষার্থী বদলির কারণে তার অভিভাবককে অনেক সময়ই গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ/তিনগুণ টাকা।

শিক্ষা বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করার পর কোনো শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান বদল করার প্রয়োজন হলে আগে যে হারে ঘাটে ঘাটে ভোগান্তি ও বৈধ অবৈধ পথে অর্থ ব্যয় হতো এখন অনলাইন ব্যবস্থা চালু হবার ফলে তা কিছুটা কমেছে। যদিও এই ব্যবস্থাটি আরো বেশি গতিশীল হবার দাবি রাখে। তবে এইরূপ আবেদনকারী শিক্ষার্থীর নিকট থেকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বাপর উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যুক্তিযুক্ত প্রাপ্যের অধিক টাকা আদায় করে থাকে। বোর্ডের ইস্যুকৃত টিসির আদেশে এই সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন যে কোনো প্রতিষ্ঠান কোন মাস পর্যন্ত বেতন-ফি নিতে পারবে।

শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় জানুয়ারি মাসে। নতুন বছরের শুরুতে বিভিন্ন কারণে অনেক বেশি শিক্ষার্থী বদল করে থাকে প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে শুধু একটি টিসি পেপার সংগ্রহ করার জন্য পূর্ণ বছরের সেশন ও অন্যান্য চার্জ এবং জানুয়ারি মাসের বেতন দিয়ে তাদেরকে ভর্তি হতে হয় আগের প্রতিষ্ঠানে। তদুপরি টিসি ফি দিয়ে টিসি পেপারটি নিয়ে গিয়ে অনুরূপ বেতন-ফি আবার পরিশোধ করে পুনরায় ভর্তি হতে হয় কাঙ্ক্ষিত নতুন প্রতিষ্ঠানে। এসংক্রান্ত দুই-একটা বাস্তব উদাহরণ দিই, যা এই চলতি জানুয়ারি মাসেই আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং এই লেখাটির তাগিদ অনুভব করেছি। নাম প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী আরো বেশি হয়রানির শিকার হতে পারে এমন ধারণা হচ্ছে বিধায় তাদের ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম গোপন রাখছি।

উদাহরণ-১। ঢাকা শহরের লালবাগ এলাকায় অবস্থিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী অত্যন্ত ভালভাবে পাস করেছে। ২০১৬ সেশনে সে খুলনায় অবস্থিত অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষাসমূহে অংশ নিয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাই ঢাকার লালবাগে অবস্থিত তার আগের প্রতিষ্ঠানটিতে সে ২০১৬ সেশনে ৭ম শ্রেণিতে আর ভর্তি হয়নি এবং হবে না; কিন্তু খুলনায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠান তাকে ভর্তির জন্য টিসি চাওয়ার কারণে বেকায়দায় পড়েছে সে। কারণ খুলনায় টিসি ছাড়া তাকে ভর্তি করবে না, আর ঢাকায় আবার ভর্তি না হলে তাকে টিসি দেয়া হবে না! ঢাকার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে- আমাদের এখানে ভর্তিই যদি না হয় তো আমরা টিসি দিব কীভাবে? অর্থাত্ তাদের নির্ধারিত অ্যাডমিশন ফিসহ আর্ট-ক্রাফট, বিএনসিসি, বেজ, বুকলিস্ট, ক্যালেন্ডার, ক্লাস টেস্ট, কম্পিউটার, ডেভেলপমেন্ট, ডায়রি, গার্সগাইড, আইডি কার্ড, লাইব্রেরি, মেডিক্যাল, প্রগ্রেস রিপোর্ট, পোস্টেজ, রিসিপ্ট বুক, রিপেয়ার, মেইনটেনেন্স, সাইন্স, স্কাউট, সোল্ডার স্টেপ, স্পোর্টস, সিলেবাস, টিউশন, ওয়েল ফেয়ার ইত্যাদি ফি বাবদ প্রায় দশ হাজার টাকা দিয়ে ভার্তি হয়ে তাদের শিক্ষার্থী হবার পরে তারা টিসি দিবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষার্থী তো এখানে ক্লাস করবে না, পড়বে না, তাহলে তাকে এতসব মাসিক ও বার্ষিক ফি দিতে হবে কেন? তাছাড়া সে ভর্তি না হবার ফলে ঢাকার প্রতিষ্ঠানে যে আসনটি খালি হবে সেটিতো আর একবছর ফাঁকা থাকবে না। ওয়েটিং লিস্ট থেকে টেনে আরেক জনকে ভর্তি করা হবে এবং তার নিকট থেকেও উল্লিখিত বেতন-ফি আদায় করা হবে। একই আসনের বিপরীতে একই সেশনে দুইজন শিক্ষার্থীর নিকট থেকে টাকা আদায় করা কি বাণিজ্য নয়? সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি এইরূপ অন্যায় বাণিজ্য করতে পারে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে? তাদের উত্তর হচ্ছে- এত কথা বলে লাভ নেই, এটিই এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম! অপরদিকে খুলনার সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে- আমাদের এখানে ভর্তি করতে হলে টিসি লাগবে। সেখানে প্রশ্ন হচ্ছে- এই শিক্ষার্থী তো এখন কোথাও ভর্তি নেই, তো তাকে টিসি দিবে কে? কিংবা তাকে ভর্তি করতে টিসি লাগবে কেন? সে/তার অভিভাবক যদি লিখে দেয় যে, সে অন্য কোথাও ভর্তি নেই তাহলে কি চলবে না? কিংবা তার আগের প্রতিষ্ঠান যদি লিখে দেয় যে, “অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই” তাহলে কি তাকে ভর্তি করা যায় না? [যদিও বিনা টাকায় এমনটি তারা দিবে কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই] সেখানে তাদের উত্তর হচ্ছে, এত কথা আমাকে বলে লাভ নেই, টিসি ছাড়া এখানে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় না, এটাই এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম! এখন না পারলে, পরে হলেও দিতে হবে।

[অথচ, শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট কার্ডটির কোনো একটি কলামে যদি এমন লেখা থাকে যে, “সে এই প্রতিষ্ঠানের... শ্রেণিতে ভর্তির যোগ্য। তবে, তার অন্যত্র ভর্তির ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই এবং থাকবে না।” আর সেটির ভিত্তিতে যদি অন্য প্রতিষ্ঠান তাকে ভর্তি নিত; তাহলে তো আলাদা করে অনাপত্তিপত্র বা টিসির প্রয়োজন হতো না।]

উদাহরণ-২। ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুরে অবস্থিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি পাস করেছে একজন শিক্ষার্থী। সে ২০১৬ সেশনে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ফার্মগেট এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে সিলেক্ট হয়েছে; কিন্তু তারা টিসি ব্যতীত তাকে ভর্তি করবে না। এদিকে যে প্রতিষ্ঠান থেকে সে জেএসসি পাস করেছে সেই প্রতিষ্ঠানেও ভর্তি না হলে তারা টিসি দিবে না। এখানে পড়ুক বা না পড়ুক- টিসি নিতে হলে নির্ধারিত সকল ফি দিয়ে এক মিনিটের জন্য হলেও ভর্তি হতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জেএসসি/পিইসি/এসএসসি/এইচএসসি পাসের সরকারি সনদ থাকার পরেও তাকে ভর্তি করার জন্য টিসি লাগবে কেন? যে সনদ এখন অনলাইনে দেখা যায়, পাওয়া যায়, প্রিন্ট করা যায়- সেই সনদের কপি সত্যায়িত করা লাগবে কেন আগের প্রতিষ্ঠান প্রধানের? কেন বাড়তি টাকা দিয়ে আগের প্রতিষ্ঠান থেকে আনতে হবে প্রশংসাপত্র? সে খারাপ হলে তো তাকে পরীক্ষা দেয়ার পূর্বেই বহিষ্কার করে দিত আগের প্রতিষ্ঠান। কিংবা দিত না তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ। সরকারি সনদই যথেষ্ট নয় তার নতুন ভর্তির জন্য? উত্তর, এত কথা বলে লাভ নেই, এটাই নিয়ম!

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, আপনারাই বলুন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান বদলের ক্ষেত্রে ও উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত এই নিয়মগুলো কি আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত চরম অনিয়ম নয়? এই অনিয়ম রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি কিছু করণীয় নেই?

লেখক :অধ্যক্ষ,

 কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।

E-mail: rahamot21@gmail.com

No comments:

Post a Comment