Friday, October 23, 2015

আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জাতীয় শপথ থাকা জরুরি

আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জাতীয় শপথ থাকা জরুরি

মো. রহমত উল্লাহ্‌ | 20-10-2015  দৈনিক শিক্ষা ডট কম
http://dainikshiksha.com/news.php?content_id=10578

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি ভাবে নির্ধারিত কোন শপথ আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করতে গিয়ে গত ২০১১ সালে কথা বলেছিলাম বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক গণের সাথে। ফোন করেছিলাম বিভিন্ন দপ্তরে ও প্রতিষ্ঠানে।
তখন কেউই দিতে পারেননি নিশ্চিত তথ্য। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদশর্ক জানিয়ে ছিলেন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত কোন শপথ আছে এমনটি তাঁর জানা নেই। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বলেছিলেন- আমার অফিসে এই মর্মে কোন সার্কুলার আদৌ আছে কি না আমি বলতে পারবো না।


সেমতাবস্থায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তব্যে ও ভাষায়  শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য পাঠ অস্বাভাবিক ছিলনা। হয়ত সে কারণেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ডায়রিতে বিভিন্ন রকম শপথ বাক্য লক্ষ্য করা গেছে। সাধু বা চলিত অথবা মিশ্র ভাষায় লিখিত বাক্য গুলো ছিল মোটামুটি নিম্নরূপ: “আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখিব। দেশের প্রতি অনুগত থাকিব। দেশের একতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিবার জন্য সচেষ্ট থাকিব। হে আল্লাহ্, আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন দেশের সেবা করিতে পারি এবং বাংলাদেশকে একটি আদর্শ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারি। আমীন।”  অথবা “আমি শপথ করছি যে, কলেজের সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলব। নিষ্ঠা ও মনোযোগসহকারে লেখাপড়া করব। কলেজের সুখ্যাতি ও মান-উন্নয়নে সচেষ্ট থাকব। দেশ ও মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখব। স্বধর্মের সকল বিধি-বিধান মেনে চলব। হে আল্লাহ্, আমাকে শক্তি দিন। আমি যেন কলেজের ভাবমূর্তিকে উজ্জল করতে পারি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সেবা করতে পারি। আমীন।”

আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ডায়রিতে কোন শপথ বাক্য ছিলনা এবং নেই। দেশের লাখো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন ডায়রি এখনো নেই। সম্ভবত এবিষয়ে আমার একাধিক লেখালেখি ও একাধিক দপ্তরে ঘাটাঘাটি করার কারণে গত ২০১৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি শপথ বাক্য দেওয়া হয়েছে। যা এই রূপ "আমি শপথ করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব
দেশের প্রতি অনুগত থাকিব। দেশের একতা এবং সংহতি বজায় রাখিবার জন্য সচেষ্ট থাকিব।
অন্যায় ও দুর্নীতি করিব না এবং অন্যায় ও দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দিব না। হে প্রভু, আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন বাংলাদেশের সেবা করিতে পারি, বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ও আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারি-আমীন।" এটিও ধর্ম নিরপেক্ষ ও চলতি ভাষায় নয়, পরিপূর্ণ নয়।

সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শপথ বাক্য হুবহো পাঠের বাধ্য-বাদকতা থাকলেও তা পুরোপুরিভাবে মানেন নি / মানেন না সবাই; বিশেষ করে অধিকাংশ মাদ্রাসা। এমতাবস্থায় বিশেষ করে যেসকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সদা মারতে ও মরতে প্রস্তুত, তারা গোপনে কী (সৃজণশীল?) শপথ গ্রহণ করে তা গভীর ভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
  
সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন ইচ্ছে তেমন  শপথ পড়া বা একেবারেই না পড়া দেশ ও জাতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।

প্রথমত: এতে করে ভিন্ন ভিন্ন মন-মনসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছি আমরা এবং উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। ক্রমে বেড়েই চলছে আমাদের ও আমাদের উত্তরাধিকারদের বিভক্তি। আরো বেশি আদর্শ হীন, দয়ীত্ব-কর্তব্যহীন, দেশপ্রেমহীন, মানবতাহীন, চরিত্রহীন হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ সন্তান।

দ্বিতীয়ত: আমাদের সকল ক্লাসের সকল পাঠ্য বই চলতি ভাষায় রচিত। বি.সি.এস. পরিক্ষাসহ সকল পরিক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর চলতি ভাষায়। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও রণ সঙ্গীত চলতি ভাষায়। জাতীয় সংসদ সদস্যদের শপথ হয় চলতি ভাষায়। ছড়া, কথা, গান, কবিতা, বিতর্ক, বক্তৃতা সবই হয় চলতি ভাষায়। তাই স্কুল-কলেজে-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য অবশ্যই হতে হবে বাংলা ভাষায় এবং চলতি ভাষায়।

তৃতীয়ত: জীবনের শুরুতে সকলের জন্য চাই- সুশিক্ষা অর্জনের শপথ। সঠিক ভাবে নিজেকে ও নিজের বিবেককে তৈরি করার শপথ। সৎ ও নীতিবান থাকার শপথ। দুর্নীতি মুক্ত থাকার শপথ। জাতীয়তা বোধ তৈরির শপথ। যেই মজবুত শপথ বুকে নিয়ে সহজেই সম্ভব  দেশ, জাতি ও মানুষের সত্যিকার কল্যাণ।

শুধু মাত্র নিচের ক্লাসের অবুঝ শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পাঠের জন্যই নয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক থাকা চাই একটি সহজবুদ্ধ অর্থবহ নিরপেক্ষ শপথ। যা হবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মতই জতীয় শপথ। এই শপথ থাকতে পারে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্য বইয়ের শুরুতে। সরকারি-বেসরকারিসহ সকল প্রতিষ্ঠানের  প্রোসপেকটাস ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, পত্র, পত্রিকায়। সকল প্রশিক্ষণ একাডেমিতে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে। বিভিন্ন  জাতীয়দিবসে আমাদের জাতীয় সংগীতের আগে-পরে ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরে, সাংসদ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রষ্ট্রপতিসহ সর্বস্তরের মানুষ খুলা ডানহাত বাম বুকে(হৃদয়ে) অথবা ভূমির সমান্তরালে রেখে বার বার গ্রহণ করতে পারেন আমাদের নির্ধারিত জাতীয় শপথ। নবীন বরণ, বিদায়, সমাবর্তনসহ বিভিন্ন ছোট-বড় অধিবেশন ও অনুষ্ঠানের শুরুতে ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর পরই হতে পারে, ভালো হওয়ার ও ভালো করার সুদৃঢ় শপথ। যাতে বার বার জাগ্রত হয় আমাদের বিবেক, শানিত হয় আমাদের চেতনা, উজ্জীবিত হয় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। সঞ্জীবিত হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অসীম শক্তি। আমাদের সেই সার্বজনিন শপথটি হতে পারে এই রূপ: [‘আমি শপথ করছি যে, -সদা সত্য কথা বলবো ও সৎ পথে চলবো। ছোটদের স্নেহ ও বড়দের মান্য করবো। সুশিক্ষা অর্জনে আমরণ আন্তরিক থাকবো। প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও স্বধর্মের সকল বিধি-বিধান মেনে চলবো। ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো। আমাদের জাতীয় চেতনা, একতা ও স্বাধীনতা সুরক্ষায় সর্বদা সক্রিয় থাকবো। হে সর্বশক্তিমান, আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন সুনাগরিক হয়ে- প্রতিষ্ঠান, মাতৃভূমি ও মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে পারি।’ ]

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ছড়াকার, এবং তালিকাভুক্ত গীতিকার- বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।
rahamot21@gmail.com

4 comments: