Monday, September 16, 2013

ভোটের রাজনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংক

ভোরের কাগজ 
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩

ভোটের রাজনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংক
মো. রহমত উল্লাহ
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত প্রায় ৬০ লাখ পরিবারের কমবেশি দেড় কোটি ভোটার আসন্ন নির্বাচনে একটা উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। যে করেই হোক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই স্বল্পশিক্ষিত ভোটারদের মনে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল করতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার আবার ক্ষমতায় এলে গ্রামীণ ব্যাংক থাকবে না অথবা থাকলেও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের স্বার্থ চরমভাবে বিঘিœত হবে। তাকে বিধিমতো অবসরে পাঠানোর পর থেকে তিনি বারবার এ কথা বলেছেন যে, এ দেশের দরিদ্র মানুষের গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে টুকরা টুকরা করে ধ্বংস করতে দেয়া হবে না। যাদের ব্যাংক তারাই তা রক্ষা করবে। তার এই কথায় গ্রামীণ ব্যাংক তথা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ব্যাংকের গ্রাহকরা। ভোটের রাজনীতির হিসাব করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বিএনপিসহ মহাজোট বিরোধী বিভিন্ন ছোট-বড় রাজনৈতিক দল এবং তারা ব্যাংকের গ্রাহকদের এমন একটি ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, বিএনপি-জামাত-হেফাজত জোট ক্ষতায় এলে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্যাংকের গ্রাহকদের স্বার্থ অক্ষুণœ থাকবে। আরো অবাক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংক সর্বোচ্চ সুদের ব্যবসা জেনেও ইসলাম ধর্ম নিয়ে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতি করে তারাও এখন ভোটের রাজনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার নামে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে মহাজোট বিরোধী আন্দোলনকে মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার জাতির সামনে এখনো এটি পরিষ্কার করতে পারেনি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে আসলে তারা কী করতে চাচ্ছেন। তদুপরি তারা এটিও সার্বজনীনভাবে প্রমাণ এবং বিশ্বাস করাতে পারেননি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় বাংলাদেশ সরকারও বড় অংশীদার এবং সেই কারণে এই ব্যাংকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার আইনগত অধিকার সরকারের রয়েছে। আর সরকারের এই নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকের গ্রাহকদের স্বার্থ বিনষ্ট হবার কোনো সুযোগ নেই এবং হবে না।

গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকেই দেশ-বিদেশের সকল মানুষের এমন একটি ধারণা বিদ্যমান যে, এটি ড. ইউনূসের ব্যাংক। শুধু অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও সংশ্লিষ্টরাই নয়; অনেক শিক্ষিত মানুষও নোবেল বিজয়ের পর এই ধারণা পোষণ করেন যে, গ্রামীণ ব্যাংক মানেই ড. ইউনূস, আর ড. ইউনূস মানেই গ্রামীণ ব্যাংক। ভুল-সঠিক যাই হোক; বিভিন্ন ভূমিকার মাধ্যমে এই ধারণাটি সঠিক প্রমাণ, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ড. ইউনূস যতোটা সফল হয়েছেন; তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যর্থ হয়েছে অতীতের সকল সরকার যে, এই ব্যাংকের বড় একটা অংশের মালিক বাংলাদেশ সরকার তথা দেশের সকল মানুষ। অথচ সেই ব্যর্থতার দায় এখন স্বেচ্ছায় ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে বর্তমান মহাজোট সরকার। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, এখনো গ্রামের চায়ের টেবিলে মহাজোটের অনেক তুখোড় নেতাকর্মীরাই পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না, কার কী স্বার্থে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার কী করতে চাচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মুখ বন্ধ করে শুনতে হচ্ছে যে, মহাজোট সরকার গরিবের গ্রামীণ ব্যাংক ডাকাতি করতে চাচ্ছে। এবার না পারলেও আগামীতে ক্ষমতায় এলে তাই করবে। হয়তো ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন আক্রোশমূলক কথার কারণে অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষ এটিও বলছেন যে, শুধুমাত্র ড. ইউনূসের সঙ্গে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের (ঈর্ষা) কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে এই জটিলতার এবং এর ফলেই বন্ধ হয়েছে পদ্মা সেতুর অর্থায়নও। মোট কথা প্রতিকূলতায় পড়েছে মহাজোট সরকার এবং ভোট কমেছে আসন্ন নির্বাচনের। অথচ ভোটের রাজনীতিতে জিতার জন্য অতীতের মতোই এই মেয়াদের অভারলোক করা যেতো গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের ব্যাপারটি অথবা ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো এতোটা কালক্ষেপণ না করে অনেক আগেই সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করা যেতে পারতো যে, ড. ইউনূসকে সরকারি নিয়ম অনুসারে রিটায়ারমেন্টে পাঠানোর পরেও গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো ক্ষতি হয়নি এবং ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গ্রাহকদের কোনো স্বার্থও বিনষ্ট হয়নি, হচ্ছে না, হবে না। ড. ইউনূস মরে গেলেও গ্রামীণ ব্যাংক মরে যাবে না। বরং সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকলে ভবিষ্যতে গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষার দায়দায়িত্ব থাকবে সরকারের; তা যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক। তদুপরি গ্রামীণ ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (যাদের অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় কম বেতনভাতা দেয়া হচ্ছে শুরু থেকেই) বেতনভাতা সামান্য বৃদ্ধি করে এবং চক্রবৃদ্ধিক সুদের টাকা পরিশোধে অক্ষম ঋণ গ্রহীতাদের কিছুটা সুদ মওকুফ করে সামান্য দায়মুক্ত করেই নিশ্চিত করতে পারতো এই ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভোটারদের পূর্ণ সমর্থন। জিরো করে দিতে পারতো ড. ইউনূসের সকল আন্দোলন এবং তা এখনো সম্ভব। ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে যে দল বা জোটের সর্মথক হোক না কেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সকল গ্রাহক কিন্তু তা ছিল না। একটা বাস্তব ঘটনা বলি: আমি যখন মফস্বল শহরের একটা কলেজে প্রভাষক ছিলাম তখন আমার রান্না করতেন একজন বৃদ্ধা। তার বক্তব্য মতে তার বয়স ৮০ বছরের কম নয়। বয়সের তুলনায় বেশ শক্ত। কথাবার্তায়ও স্টেটকাট। আমাকে মামা বলতেন। আমিও খালা বলতাম। বেশ দরদি ছিলেন। বিভিন্ন সময় এমন সব কথা বলতেন যা ভুলবার নয়। যেমন: “মামা, তাবিজ-কবজ আর হোনাপাতি অষুদের পানি এক কথা। এইত্যানে কি জ্বর যাইবো? কেপসল খান।” “আমারে রোজা রাখতে কইয়েন না, মামা। তিশদিন কি রোজা রাখমো? আল্লায়তো আমারে সারা বছরই রোজা রাখায়।” “আমি সিরার মায় কি এই বসে ঘরের বাইরে আইতাম, আপনার বাসায় কাম করতাম? মরছি তো গেরামিন ব্যাংকে যাইয়া। সিরার বিয়ার সময় টেহা আইন্না গুচ্ছ গেরামে একটা ঘর বানাইছিলাম। এখন সাপ্তা গেলেই কিস্তি দেও। কতো বছর ধইরাযে টেহা দিতাছি, আর শেষ অন না। যার লাইগা ঘর বানাইছি হেয় তো কিস্তির টেহা দেয় না! আমার অইছে বিপদ! মরলেও মাফ নাই।” এমন একটা দুইটা নয়, অনেক করুণ ঘটনা আছে এই গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহকদের অনেকের জীবনে। গ্রামীণ ব্যাংকে তো অন্যান্য ব্যাংকের মতো মানুষ টাকা জমা রাখে না, বিনিয়োগ করে না, সঞ্চয় করে না। সমিতির মতো চাঁদা দয়ে এবং সেই টাকা থেকেই ধার নেয়। কিস্তিতে সেই টাকা ফেরত দেয়, সেই টাকার সুদ দেয়, দেরি হলে সুদের ওপরও সুদ দেয়, তার ওপরেও সুদ দেয়। সুদের টাকাই ব্যাংকের সম্পদ। যেই গ্রাহকরা দেনাদার তারা কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক? গ্রামীণ ব্যাংক না থাকলে বর্তমান ঋণ গ্রহীতাদের কী যায় আসে যে তারা এই গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার জন্য আজ রাস্তায়? গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে আদায়কৃত বিপুল সুদের টাকার যারা ভাগ পায় ও চাকরি করে বেতন পায় তারা তা রক্ষার জন্য আন্দোলন করবে, সংগ্রাম করবে, মিটিং-মিছিল করবে এটাই তো বাস্তব। ড. ইউনূস তো তাদেরই একজন। এই বাস্তবতাটুকু মহাজোট সরকারের গুরুজনগণ বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী মহোদয় নিজে অনুভব করতে এবং ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা ও দেশবাসীকে অনুভব করাতে পারছেন বলে তো এখনো মনে হয় না। যদি পারতেন তো আজকের এই পরিস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত ভোটাররা প্রকাশ্যে অবস্থান নিতো মহাজোট সরকারের প্রস্তাবিত সংস্কার পদক্ষেপের পক্ষে। কিন্তু তা হয়নি, হচ্ছে না, সম্ভাবনাও দেখছি না এখন পর্যন্ত। যা দেখছি তাহলো গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দলীয় ও বিভিন্ন দলীয় সাধারণ মানুষগুলোকে ভোটের রাজনীতিতে টেনে এনে মহাজোট সরকার নিজেই সক্রিয় করে দিলো নিজেদের বিরুদ্ধে! যা অত্যন্ত দুখঃজনক।
[মো. রহমত উল্লা : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।]  http://www.bhorerkagoj.net/new/blog/2013/09/16/137966.php

No comments:

Post a Comment